জিয়া কেন মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় মেতে উঠেছিলেন : তদন্ত কমিশন প্রয়োজন

১৬ মে ২০১৯, ১৫:১৮ | অনলাইন সংস্করণ

সম্প্রতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে একটি রীট মামলা করা হয়েছে, যেখানে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনা ও বিমান বাহিনীর যে ৪৮৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাঁদের পরিবারের কয়েকজন সদস্য বিষয়টির পুনর্বিচার ও ক্ষতিপূরণ প্রার্থনা করেছেন। পাঠকরা স্মরণ করুন, জিয়াউর রহমানের পাঁচ বছর ছয় মাস তেইশ দিন মেয়াদের অবৈধ শাসনামলে মোট ১৯টি থেকে ২১টি ব্যর্থ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল বা অভ্যুত্থান-ষড়যন্ত্র উদঘাটিত হয়েছিল দাবি করা হয়েছে, যেগুলোতে অংশগ্রহণের দায়ে উল্লিখিতসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দিয়ে কিংবা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বই ডেমোক্রেসী এন্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট: এ স্টাডি অব পলিটিক্স এন্ড মিলিটারী ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ এর ৬৯ পৃষ্ঠায় ফাঁসি এবং ফায়ারিং স্কোয়াডে নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা ৪৮৮ বলা হয়েছে। আরো ৫০০ জন নাকি প্রাণভয়ে পালিয়েছিলেন এবং প্রায় এক হাজার জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল বলে ঐ বইয়ে বলা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা কয়েক হাজার ছিল বলে জিয়ার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো দাবি করলেও তাঁর মৃত্যুর আটত্রিশ বছর পরও আজো তদন্ত কমিশন গঠন করে ঘটনাগুলোর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন এবং নিহতদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণের ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। এজন্যেই হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতিদের প্রতি আমার আবেদন, একটি শক্তিশালী বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের আদেশ দিয়ে এই ১৯-২১টি কথিত অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মঞ্চায়িত বিচারিক প্রহসনের স্বরূপ উদঘাটন করুন। শত শত মুক্তিযোদ্ধা নিধনকারী জিয়ার পাকিস্তানী মুখোশ উন্মোচনের জন্যে এটা একান্তই আবশ্যক।
বাংলাদেশের রাজনীতির ট্র্যাজেডি হলো, জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর তাঁর পাঁচ বছর ছয় মাস তেইশ দিন মেয়াদের শাসনামলে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যাবতীয় চেতনা ও সাফল্যকে বিসর্জন দিয়ে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দেশটাকে আবার পাকিস্তানে রূপান্তরিত করা হয়েছিল । অথচ, তিনি ছিলেন ‘বীর উত্তম’ খেতাবপ্রাপ্ত দেশের একজন নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাও প্রদান করেছিলেন। (২৬ মার্চ দুপুরে জনাব এম এ হান্নান প্রথম এবং সন্ধ্যায় আবুল কাশেম সন্দ্বীপ আরো দু’বার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন।) ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়ার মৃত্যুর পর প্রায় ৩৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও তাঁর সৃষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপি এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চিন্তাধারা এবং কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার মাধ্যমে এটাই প্রমাণ করে চলেছে, জিয়াউর রহমান যে পাকিস্তানী ভাবধারার অনুসারী ছিলেন তা থেকে তাঁর স্ত্রী-পুত্র বিচ্যুত হতে রাজী নন।
এ-পর্যায়ে ইতিহাস পর্যালোচনা হিসেবে বলছি, ১৭৫৭ সালে একবার, ১৯৪৭ সালে আরেকবার ঔপনিবেশিক দখলদারির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে শোষণ, লুণ্ঠন, বঞ্চনা ও সর্বোপরি অমানবিক হত্যাযজ্ঞের লীলাক্ষেত্র হয়েছে এদেশ। আবার, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের পথ বেয়ে এবং দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জতের মূল্য চুকিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে এ-জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্র। এই জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস ১৯৫২ এর ভাষা সংগ্রাম, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফার সংগ্রাম, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনকে ধারণ করতেই হবে। এই সংগ্রামগুলোর ধারাবাহিকতায় জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে জাতিকে বিজয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়েছিলেন জনাব তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারবৃন্দ ও লাখো মুক্তিযোদ্ধা। অতএব, ভাষা সংগ্রাম, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে অবমূল্যায়ন করে মুক্তিযুদ্ধকে হঠাৎ শুরু হওয়া ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ অভিহিত করা সম্পর্কিত বিএনপি’র বিকৃত ও মিথ্যা ইতিহাসের বেসাতিকে ’ইতিহাসের আঁস্তাকুুড়ে’ নিক্ষেপ করার প্রয়োজনে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে এই সঠিক পদ্ধতিতে বিবেচনা করতেই হবে। বিএনপি’র ভাষ্যমতে জিয়ার ঘোষণার মাধ্যমে নাকি ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ শুরু হয়েছিল, ওরা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি উচ্চারণই করতে নারাজ। বিএনপি দাবি করেই চলেছে, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে কোন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাননি। এর ফলে জনগণ নাকি বিভ্রান্তির কবলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল যেখান থেকে জিয়ার ঘোষণা জাতিকে পথ দেখিয়েছিল। তাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কোন গুরুত্ব নেই, তারা ঐ ভাষণ ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রেডিও-টেলিভিশনে বাজানো পর্যন্ত নিষিদ্ধ রেখেছিল। (সম্প্রতি জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ঐ ভাষণকে মানবজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ঘোষণা তাদের এহেন ধৃষ্টতার প্রতি চপেটাঘাত!) আমরা জানি, আওয়ামী লীগের নেমেসিস হিসেবেই ১৯৭৮ সালে বিএনপি’র জন্ম দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু, বাংলাদেশে রাজনীতি করব অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে অস্বীকার করব কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করব, এই অধিকার বিএনপি’র নেই। বিএনপি ১৯৬৬ সালের ছয় দফার কথা উচ্চারণও করে না, ৭ জুনের ছয় দফা দিবসও পালন করে না। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্রে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা–এগুলোর কোন ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই বিএনপি’র কাছে। তখন তো বিএনপি’র জন্মই হয়নি, কী যুক্তিতে তারা এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করছে?
আমরা জানি, জিয়া নিজের ক্ষমতার ভিতকে মজবুত করার প্রয়োজনে বাংলাদেশের রাজনীতিকে সুপরিকল্পিতভাবে আবারো ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি আদলের ধর্মান্ধতা, সামপ্রদায়িকতা, ভারতবৈরিতা ও মার্কিন-প্রেমের পুরানো দুষ্টচক্রে। জিয়া পারিবারিকসূত্রে করাচীতে কৈশোর ও তরুণজীবন অতিবাহিত করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থায়ও চাকরি করেছেন তিনি। তিনি বাংলায় কথা বলতে ও বাংলা পড়তে জানলেও লিখতে জানতেন না জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার বলা হয়, অথচ পাঁচ বছর ছয় মাস তেইশ দিন দেশটাকে শাসন করা সত্ত্বেও বাংলা লিখতে শেখার কোন গরজ জিয়ার মধ্যে সৃষ্টি হলো না! ইতিহাসের আরো চরম পরিহাস হলো, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের ষোলশহর থেকে একটি আর্মি কনভয়সহ তাঁকে পাঠানো হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রবাহী জাহাজ ‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্র খালাসে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী জনগণকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব দিয়ে। ঢাকার গণহত্যার খবর পেয়ে ওখান থেকে সহকর্মীরা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। অতএব, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা হননি, ২৫-২৭ মার্চের ঘটনাপ্রবাহ তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঘটনাক্রমে চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর থেকে বোয়ালখালীতে পশ্চাৎপসরণকারী সামরিক কর্মকর্তা ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে’ আনীত হলেন বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে। বেতার কেন্দ্রের সংগঠকরা তাঁকে রাজি করালেন একজন ‘আর্মি মেজরের’ কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি ঘোষণা প্রদানের জন্যে। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র পাকিস্তানের বোমা হামলার শিকার হয়ে ৩১ মার্চ বন্ধ হয়ে যায়, জিয়াউর রহমানও তাঁর রেজিমেন্ট নিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার হলেন তিনি। ইতিহাসের কী ট্র্যাজিক পরিহাস, ঘটনাচক্রে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসেনানী হয়েও জিয়া যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করতে পারেননি তারই অজস্র প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর পুরো শাসনামলে! সুচিন্তিতভাবে তিনি এবং তার সৃষ্ট বিএনপিতে কেনাবেচার মাধ্যমে জড়ো হওয়া সুবিধে-শিকারী রাজনৈতিক সাঙাতরা জনগণের মানসপট থেকে মুছে দিতে চাচ্ছেন ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি আদর্শ, অর্জন ও গৌরবগাথা। তাঁর মুখোশাবৃত এই পাকিস্তানি সত্তাটির নির্মোহ মূল্যায়ন করতেই হবে। কারণ, এটা অনস্বীকার্য যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন, ঐ ঐক্যবদ্ধ জাতিকে জিয়াই আবার বিভাজনের রাজনীতির কানাগলিতে প্রবিষ্ট করে গেছেন সুপরিকল্পিতভাবে।
আর, দুঃখজনকভাবে এই বিভাজনের রাজনীতিকে এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান। নইলে বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান কিভাবে অস্বীকার করেন, যখন বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ অভিহিত করা হয় তখন এই সত্যটিকেই স্বীকৃতি প্রদান করা হয় যে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকলেও বঙ্গবন্ধুর নামেই এদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি? ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণাকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হিসাবে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তখন ২৫/২৬ মার্চের রাতের ঘটনা-ঘোষণা ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক কিংবা পাল্টাপাল্টি দাবির অস্তিত্ব ছিলনা। আর, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন মর্মে একটা সাইক্লোস্টাইল করা লিফলেট ২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রামের রাজপথে বিলি করা হয়েছে, আন্দরকিল্লাহর নজীর আহমদ চৌধুরী রোডে আমি নিজেই ঐ লিফলেট পেয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধু র্কর্তৃক ২৬ মার্চের এই স্বাধীনতা ঘোষণা এদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি। এই অকাট্য সত্যকে কিভাবে অস্বীকার করা হচ্ছে যে বোয়ালখালীর অবস্থান থেকে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াকে কিছু সৈন্য সহ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধানের অনুরোধ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং বেতার কেন্দ্রের সংগঠকদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া তাঁর বিখ্যাত স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন, ২৬ মার্চে নয়? ঐদিন রাত নয়টার দিকে তিনি বেতার কেন্দ্রে এসে আরেকটি ঘোষণায় নিজেকে প্রভিশনাল সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু, উভয় ঘোষণাই বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তে নিজের নামে দেওয়ায় যখন চারিদিক থেকে প্রবল আপত্তি ওঠে তখন ঘোষণাকে যথাযথভাবে পরিবর্তন করার জন্য উপস্থিত কয়েকজনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে সুপ্রিম লীডার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে পঠিত ঐ পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত ঘোষণাটিই ইতিহাস। জিয়ার পাকিস্তানী সত্তার আরো প্রমাণ দেখুন:
১) জিয়া বাংলাদেশে স্বাধীনতা-বিরোধী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের মত দলগুলোকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করে গেছেন।
২) ১৯৭৮ সালে মাকে দেখতে আসার নাম করে জিয়ার অনুমতি নিয়ে গোলাম আজম পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিল। জিয়ার জীবদ্দশায় প্রায় তিন বছর অবস্থানের পরও জিয়া এ-ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেননি।
৩) জিয়া সকল কুখ্যাত স্বাধীনতা-বিরোধী ঘাতক-দালালকে বিএনপিতে যোগদান করার সুযোগ দিয়েছিলেন।
৪) জিয়া সকল চিহ্নিত স্বাধীনতা-বিরোধী সরকারি আমলা-কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, পেশাজীবী ও সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন।
৫) জিয়া সকল প্রচার মাধ্যমে ‘পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর’ পরিবর্তে শুধুই ‘হানাদার বাহিনী’ বলার নির্দেশ জারি করেছিলেন।
৬) জিয়া দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমি, অগ্নি-সংযোগ, শরণার্থী ক্যাম্প ও গণহত্যার চিত্র মিডিয়ায় প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
৭) পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ইস্যুকে জিয়া কখনোই অগ্রাধিকার দেননি।
৮) বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারীদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর জিয়া যথাযোগ্য চাপ সৃষ্টি করেননি।
৯) জিয়া দেশের সকল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি, জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং শহীদ মিনারের পুনর্র্নিমাণ কাজও জিয়ার আমলে পরিত্যক্ত হয়েছিল।
১০) জিয়া ঘাতক-দালালদের বিচার সংক্রান্ত সকল আইন বাতিল করে দেওয়ায় জেলে আটক প্রায় এগার হাজার স্বাধীনতা-বিরোধী মুক্তি পেয়েছিল।
এই পাকিস্তানী সত্তার কারণেই জিয়া তাঁর শাসনামলে কথিত ১৯টি থেকে ২১টি ব্যর্থ অভ্যুত্থান কিংবা অভ্যুত্থান-ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কয়েক শত মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কর্নেল তাহেরও, যিনি জিয়ার প্রাণরক্ষা করেছিলেন বলে স্বয়ং জিয়াই ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর জনসমক্ষে স্বীকার করেছিলেন। ইতোমধ্যেই কর্নেল তাহেরকে ঠান্ডামাথায় হত্যা করা হয়েছে মর্মে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। এবার, জিয়ার বাকি মুক্তিযোদ্ধা নিধনকান্ডগুলোকেও হত্যাকাণ্ড হিসেবেই চিহ্নিত করা হোক। (দৈনিক আজাদী থেকে সংগৃহীত) লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের রাজনীতির ট্র্যাজেডি হলো, জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর তাঁর পাঁচ বছর ছয় মাস তেইশ দিন মেয়াদের শাসনামলে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যাবতীয় চেতনা ও সাফল্যকে বিসর্জন দিয়ে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দেশটাকে আবার পাকিস্তানে রূপান্তরিত করা হয়েছিল । অথচ, তিনি ছিলেন ‘বীর উত্তম’ খেতাবপ্রাপ্ত দেশের একজন নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাও প্রদান করেছিলেন। (২৬ মার্চ দুপুরে জনাব এম এ হান্নান প্রথম এবং সন্ধ্যায় আবুল কাশেম সন্দ্বীপ আরো দু’বার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন।) ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়ার মৃত্যুর পর প্রায় ৩৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও তাঁর সৃষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপি এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চিন্তাধারা এবং কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার মাধ্যমে এটাই প্রমাণ করে চলেছে, জিয়াউর রহমান যে পাকিস্তানী ভাবধারার অনুসারী ছিলেন তা থেকে তাঁর স্ত্রী-পুত্র বিচ্যুত হতে রাজী নন।
এ-পর্যায়ে ইতিহাস পর্যালোচনা হিসেবে বলছি, ১৭৫৭ সালে একবার, ১৯৪৭ সালে আরেকবার ঔপনিবেশিক দখলদারির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে শোষণ, লুণ্ঠন, বঞ্চনা ও সর্বোপরি অমানবিক হত্যাযজ্ঞের লীলাক্ষেত্র হয়েছে এদেশ। আবার, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের পথ বেয়ে এবং দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জতের মূল্য চুকিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে এ-জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্র। এই জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস ১৯৫২ এর ভাষা সংগ্রাম, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফার সংগ্রাম, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনকে ধারণ করতেই হবে। এই সংগ্রামগুলোর ধারাবাহিকতায় জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে জাতিকে বিজয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়েছিলেন জনাব তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারবৃন্দ ও লাখো মুক্তিযোদ্ধা। অতএব, ভাষা সংগ্রাম, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে অবমূল্যায়ন করে মুক্তিযুদ্ধকে হঠাৎ শুরু হওয়া ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ অভিহিত করা সম্পর্কিত বিএনপি’র বিকৃত ও মিথ্যা ইতিহাসের বেসাতিকে ’ইতিহাসের আঁস্তাকুুড়ে’ নিক্ষেপ করার প্রয়োজনে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে এই সঠিক পদ্ধতিতে বিবেচনা করতেই হবে। বিএনপি’র ভাষ্যমতে জিয়ার ঘোষণার মাধ্যমে নাকি ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ শুরু হয়েছিল, ওরা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি উচ্চারণই করতে নারাজ। বিএনপি দাবি করেই চলেছে, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে কোন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাননি। এর ফলে জনগণ নাকি বিভ্রান্তির কবলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল যেখান থেকে জিয়ার ঘোষণা জাতিকে পথ দেখিয়েছিল। তাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কোন গুরুত্ব নেই, তারা ঐ ভাষণ ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রেডিও-টেলিভিশনে বাজানো পর্যন্ত নিষিদ্ধ রেখেছিল। (সম্প্রতি জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ঐ ভাষণকে মানবজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ঘোষণা তাদের এহেন ধৃষ্টতার প্রতি চপেটাঘাত!) আমরা জানি, আওয়ামী লীগের নেমেসিস হিসেবেই ১৯৭৮ সালে বিএনপি’র জন্ম দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু, বাংলাদেশে রাজনীতি করব অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে অস্বীকার করব কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করব, এই অধিকার বিএনপি’র নেই। বিএনপি ১৯৬৬ সালের ছয় দফার কথা উচ্চারণও করে না, ৭ জুনের ছয় দফা দিবসও পালন করে না। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্রে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা–এগুলোর কোন ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই বিএনপি’র কাছে। তখন তো বিএনপি’র জন্মই হয়নি, কী যুক্তিতে তারা এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করছে?
আমরা জানি, জিয়া নিজের ক্ষমতার ভিতকে মজবুত করার প্রয়োজনে বাংলাদেশের রাজনীতিকে সুপরিকল্পিতভাবে আবারো ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি আদলের ধর্মান্ধতা, সামপ্রদায়িকতা, ভারতবৈরিতা ও মার্কিন-প্রেমের পুরানো দুষ্টচক্রে। জিয়া পারিবারিকসূত্রে করাচীতে কৈশোর ও তরুণজীবন অতিবাহিত করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থায়ও চাকরি করেছেন তিনি। তিনি বাংলায় কথা বলতে ও বাংলা পড়তে জানলেও লিখতে জানতেন না জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার বলা হয়, অথচ পাঁচ বছর ছয় মাস তেইশ দিন দেশটাকে শাসন করা সত্ত্বেও বাংলা লিখতে শেখার কোন গরজ জিয়ার মধ্যে সৃষ্টি হলো না! ইতিহাসের আরো চরম পরিহাস হলো, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের ষোলশহর থেকে একটি আর্মি কনভয়সহ তাঁকে পাঠানো হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রবাহী জাহাজ ‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্র খালাসে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী জনগণকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব দিয়ে। ঢাকার গণহত্যার খবর পেয়ে ওখান থেকে সহকর্মীরা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। অতএব, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা হননি, ২৫-২৭ মার্চের ঘটনাপ্রবাহ তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঘটনাক্রমে চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর থেকে বোয়ালখালীতে পশ্চাৎপসরণকারী সামরিক কর্মকর্তা ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে’ আনীত হলেন বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে। বেতার কেন্দ্রের সংগঠকরা তাঁকে রাজি করালেন একজন ‘আর্মি মেজরের’ কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি ঘোষণা প্রদানের জন্যে। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র পাকিস্তানের বোমা হামলার শিকার হয়ে ৩১ মার্চ বন্ধ হয়ে যায়, জিয়াউর রহমানও তাঁর রেজিমেন্ট নিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার হলেন তিনি। ইতিহাসের কী ট্র্যাজিক পরিহাস, ঘটনাচক্রে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসেনানী হয়েও জিয়া যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করতে পারেননি তারই অজস্র প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর পুরো শাসনামলে! সুচিন্তিতভাবে তিনি এবং তার সৃষ্ট বিএনপিতে কেনাবেচার মাধ্যমে জড়ো হওয়া সুবিধে-শিকারী রাজনৈতিক সাঙাতরা জনগণের মানসপট থেকে মুছে দিতে চাচ্ছেন ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি আদর্শ, অর্জন ও গৌরবগাথা। তাঁর মুখোশাবৃত এই পাকিস্তানি সত্তাটির নির্মোহ মূল্যায়ন করতেই হবে। কারণ, এটা অনস্বীকার্য যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন, ঐ ঐক্যবদ্ধ জাতিকে জিয়াই আবার বিভাজনের রাজনীতির কানাগলিতে প্রবিষ্ট করে গেছেন সুপরিকল্পিতভাবে।
আর, দুঃখজনকভাবে এই বিভাজনের রাজনীতিকে এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান। নইলে বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান কিভাবে অস্বীকার করেন, যখন বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ অভিহিত করা হয় তখন এই সত্যটিকেই স্বীকৃতি প্রদান করা হয় যে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকলেও বঙ্গবন্ধুর নামেই এদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি? ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণাকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হিসাবে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তখন ২৫/২৬ মার্চের রাতের ঘটনা-ঘোষণা ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক কিংবা পাল্টাপাল্টি দাবির অস্তিত্ব ছিলনা। আর, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন মর্মে একটা সাইক্লোস্টাইল করা লিফলেট ২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রামের রাজপথে বিলি করা হয়েছে, আন্দরকিল্লাহর নজীর আহমদ চৌধুরী রোডে আমি নিজেই ঐ লিফলেট পেয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধু র্কর্তৃক ২৬ মার্চের এই স্বাধীনতা ঘোষণা এদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি। এই অকাট্য সত্যকে কিভাবে অস্বীকার করা হচ্ছে যে বোয়ালখালীর অবস্থান থেকে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াকে কিছু সৈন্য সহ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধানের অনুরোধ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং বেতার কেন্দ্রের সংগঠকদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া তাঁর বিখ্যাত স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন, ২৬ মার্চে নয়? ঐদিন রাত নয়টার দিকে তিনি বেতার কেন্দ্রে এসে আরেকটি ঘোষণায় নিজেকে প্রভিশনাল সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু, উভয় ঘোষণাই বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তে নিজের নামে দেওয়ায় যখন চারিদিক থেকে প্রবল আপত্তি ওঠে তখন ঘোষণাকে যথাযথভাবে পরিবর্তন করার জন্য উপস্থিত কয়েকজনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে সুপ্রিম লীডার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে পঠিত ঐ পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত ঘোষণাটিই ইতিহাস। জিয়ার পাকিস্তানী সত্তার আরো প্রমাণ দেখুন:
১) জিয়া বাংলাদেশে স্বাধীনতা-বিরোধী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের মত দলগুলোকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করে গেছেন।
২) ১৯৭৮ সালে মাকে দেখতে আসার নাম করে জিয়ার অনুমতি নিয়ে গোলাম আজম পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিল। জিয়ার জীবদ্দশায় প্রায় তিন বছর অবস্থানের পরও জিয়া এ-ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেননি।
৩) জিয়া সকল কুখ্যাত স্বাধীনতা-বিরোধী ঘাতক-দালালকে বিএনপিতে যোগদান করার সুযোগ দিয়েছিলেন।
৪) জিয়া সকল চিহ্নিত স্বাধীনতা-বিরোধী সরকারি আমলা-কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, পেশাজীবী ও সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন।
৫) জিয়া সকল প্রচার মাধ্যমে ‘পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর’ পরিবর্তে শুধুই ‘হানাদার বাহিনী’ বলার নির্দেশ জারি করেছিলেন।
৬) জিয়া দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমি, অগ্নি-সংযোগ, শরণার্থী ক্যাম্প ও গণহত্যার চিত্র মিডিয়ায় প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
৭) পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ইস্যুকে জিয়া কখনোই অগ্রাধিকার দেননি।
৮) বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারীদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর জিয়া যথাযোগ্য চাপ সৃষ্টি করেননি।
৯) জিয়া দেশের সকল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি, জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং শহীদ মিনারের পুনর্র্নিমাণ কাজও জিয়ার আমলে পরিত্যক্ত হয়েছিল।
১০) জিয়া ঘাতক-দালালদের বিচার সংক্রান্ত সকল আইন বাতিল করে দেওয়ায় জেলে আটক প্রায় এগার হাজার স্বাধীনতা-বিরোধী মুক্তি পেয়েছিল।
এই পাকিস্তানী সত্তার কারণেই জিয়া তাঁর শাসনামলে কথিত ১৯টি থেকে ২১টি ব্যর্থ অভ্যুত্থান কিংবা অভ্যুত্থান-ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কয়েক শত মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কর্নেল তাহেরও, যিনি জিয়ার প্রাণরক্ষা করেছিলেন বলে স্বয়ং জিয়াই ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর জনসমক্ষে স্বীকার করেছিলেন। ইতোমধ্যেই কর্নেল তাহেরকে ঠান্ডামাথায় হত্যা করা হয়েছে মর্মে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। এবার, জিয়ার বাকি মুক্তিযোদ্ধা নিধনকান্ডগুলোকেও হত্যাকাণ্ড হিসেবেই চিহ্নিত করা হোক। (দৈনিক আজাদী থেকে সংগৃহীত) লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এই বিভাগের আরো সংবাদ